মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:১৯ পূর্বাহ্ন
মুহাম্মদ কিফায়ত উল্লাহ, টেকনাফ: মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নারীদেরকে টার্গেট করে ধরে নিয়ে যেতেন আরকান আর্মি। প্রথমে পুরুষদের কে ধরে নিয়ে যায়।পরে এলাকায় পুরুষ শূন্য হলে। তখন রোহিঙ্গা নারীদের কে ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে মেরে ফেলেন। অনেক কে গুলি করে মেরে ফেলেন। আবার অনেক কে ছেড়ে দেন। জুলুম নির্যাতনের কথা বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন রোহিঙ্গা নারী।
মিয়ানমারের রাখাল রাজ্যে আরকান আর্মি এবং জান্তা সরকারের মধ্যে কয়েক মাস ধরে সংঘর্ষ চলেই আসছে । এর মধ্যে মায়ানমারে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালাচ্ছে আরকান আর্মির সদস্যরা।
এ সময় বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নতুন করে আশ্রিত কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী অভিযোগ করে বলেন, ছেলেদেরকে ধরে নিয়ে যায় আরকান আর্মি। তখন রোহিঙ্গা নারীরা একা হয়ে পড়ে। সে সুযোগে আরকান আর্মি মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন জুলুম অত্যাচার শুরু করে। মিয়ানমারের সংঘর্ষের মধ্যে নিয়মিত নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীরা।
রোহিঙ্গা নারীরা বলেন, আমাদের ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। তখন আমরা প্রাণ বাঁচাতে এদিক ওদিক শুটাছুটি করে অন্য এলাকায় আশ্রয় নিয়ে থাকি। কিন্তু আরকান আর্মি আমাদেরকে বিভিন্ন স্কুলে আশ্রয় দেওয়ার কথা বলে জমা করে রাখতেন। পরবর্তীতে আমরা খাবার না পেয়ে চলে যেতে চাইলে আমাদেরকে কোথাও যেতে দিত না। তখন তাদের ইচ্ছামতো আমাদেরকে তাদের আস্তানায় নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হতো । ভয়াবহ নির্যাতন থেকে আমরা বাঁচতে চাই। আমরা পৃথিবীর মানুষকে জানাতে চাই। আমরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছি।আমরা বাংলাদেশে আসতাম না। নারীদের উপর যেভাবে অত্যাচার নির্যাতন শুরু করেছে। তাই আমরা এই নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য বাংলাদেশ আশ্রয় নিয়েছি।
আরকান আর্মির হাতে আমরা জিম্মি হয়ে পড়েছি। আমাদের কোন নিরাপত্তা নেই। পুরুষদের কে ধরে নিয়ে যায় , মেরে ফেলছে কি বেঁচে আছে তাও জানিনা। আমাদের আত্মীয়-স্বজন অনেক কে ধরে নিয়ে গেছে। নারীদের উপর কত নির্যাতন জুলুম করছে বলার ভাষা খুজে পাচ্ছি না। অনেক নারীদেরকে ধর্ষণ করে, গুলি করে মেরে ফেলেছে। তাঁদের হাত থেকে আমরাও রক্ষা পায়নি। তবে আমরা প্রাণ নিয়ে বেঁচে এসেছি। মেয়েদের নির্যাতনের কথা কাউকে বলতে পারছি না। আমাদের উপর যেভাবে জুলুম নির্যাতন চালাচ্ছে তারা আল্লাহর ছাড়া কেউ জানেন।
টেকনাফ শালবাগান ২৬ নং ক্যাম্পে নতুন করে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নারী হামিদা সহ কয়েকজন নারী বলেন, আমি হামিদা মিয়ানমার থেকে আসেছি। আমাদের বেশি মানুষ মেরে ফেলছে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। আমরা বেশি কষ্ট পেয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে বাংলাদেশে এসেছি । এখনো পর্যন্ত মিয়ানমারে বেশি মারামারি চলছে। বেশি মানুষ মারা গেছে। খেতে পারছে না ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে থাকার কোনো আশ্রয় না পেয়ে বাংলাদেশে চলে আসছি। ছোট ছোট ছেলেরা রাস্তাঘাটে ঘুরাঘুরি করতেছে। তামিং সং এলাকায় বিলের মধ্যে অনেক মানুষ মেরে ফেলছে।
কিছু মানুষ বেঁচে আছে, কিছু অনেক মানুষ মারা গেছে। মেয়েদেরকে বেশি নির্যাতন জুলুম করতেছে আরকান আর্মি । তাঁদের ইচ্ছা মতো ডেকে নিয়ে গিয়ে জুলুম করে মেরে ফেলতে দেখেছি। গুলি মেরে মেরে ফেলছে দেখছি ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিতে দেখছি। জবাই করে হত্যা করতে দেখছি। হাত পা বেঁধে জুলুম নির্যাতন করতেছে দেখেছি। এখনো পর্যন্ত নির্যাতন চলমান আছে। বেশি মানুষ মেরে ফেলছে, আমরা প্রাণ নিয়ে আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছে। ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার সময় আমরা কিছু মানুষ বাড়ি থেকে গায়ের কাপড় নিয়ে বের হয়ে চলে এসেছি।
আমরা আসরের সময় বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছি। কেউ আসতে পেরেছে আবার কেউ আসতে পারেনি। আমরা কোন রকম বাড়ি থেকে বের হয়ে নারাইসং এলাকায় এসেছি। সেখানে আমাদেরকে খাদ্য সামগ্রী দেওয়ার কথা বলেছিলো আরকান আর্মি। কিন্তু কিছু দেইনি, ছেলে মেয়েরা না খেয়ে মরে যেতে চাচ্ছে।
সেখান থেকে কাউকে কোথাও যেতে দিচ্ছে না বন্দী করে রেখেছে। সে খান থেকে কিছু কিছু মেয়েদেরকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করতেছে। ছেলেদেরকে মারধর করে। মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। আমরা চার পাঁচ মাস মত অনেক কষ্ট ছিলাম খাওয়া-দাওয়া কিছু দেয়নি। ছোট ছোট ছেলেরা খেতে না পেরে মারা গেছে। আরকান আর্মির ভয়ে আমরা পাহাড়ে পাহাড়ে অবস্থান করেছি।আরকান আর্মিরা অবস্থা খারাপ দেখলে আমরা পাহাড়ে লুকিয়ে থাকি। পাহাড় থেকে বের হয়ে আবার হাঁটা শুরু করি। পাহাড়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের হাত-পা নষ্ট হয়ে গেছে। পাহাড়ে পাহাড়ে দিন রাত চলে যেত। কিছু খাওয়ার ছিল না না খেয়ে না খেয়ে থাকতাম। আমাদের ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা না খেয়ে থাকতো। তাদের কি কিছু দিতে পারতাম না। বেশি কষ্ট পেয়ে এখানে এসেছি। আমরা সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছি। দুইদিন চারদিন এক সপ্তাহ এমনও দিন ছিল খেতে পারিনি। নারাইসং এলাকা থেকে মানুষ বেশি এসেছি। কিছু মানুষ আরকান আর্মি আটক করেছে। আরকান আর্মির দৌড়ানিতে কে কোথায় গেছে জানিনা। ছেলেদের কে ধরে কোথায় নিয়ে গেছে জানিনা। একেক জন একেক দিকে ছোটা ছুটিতে চলে গেছে। চলে আসার সময় বেশি মানুষকে আটক করেছে আরকান আর্মি।তাদের কোন খোঁজ খবর নেই কি মেরে ফেলছে কি বেঁচে আছে জানিনা। আমরা ৫/৬ শত মত মানুষ বের হয়েছিলাম। কিন্তু এক শত মতো কষ্ট করে আসতে পেরেছি । আর বাকি দেরকে সবাইকে আটক করেছে। কে কোথায় গেছে জানিনা।
আমাদের অনেক মন জ্বলতেছে আমাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে খাবার দেয়নি আমাদেরকে। যা মানুষ মারার আছে সবাইকে মেরে ফেলছে। আমাদেরকে সন্ধায় নারাইসং এলাকার একটি স্কুলের মধ্যে আমাদেরকে জমা করে রেখেছে। খাওয়া দাওয়া না খেতে দিত না। আমরা যখন খাওয়া দাওয়া করতে না পেরে চলে যেতে চাইছি , তখন আমাদেরকে আসতে দিত না, মারধর করতো। আমরা খাওয়া-দাওয়া না পেরে সহ্য করতে না পেরে চলে আসতে চাইলে আর আসতে দিত না, আমাদের কে ভালো করে রাখার আশা দিলেও পরে গিয়ে কিছু দিত না। না খেয়ে থাকতে থাকতে ছেলেমেয়েদের কথা চিন্তা করে চলে আসতে চাইলে আর আসতে দিত না। সবকিছু আরকান আর্মি এই সব করতো । এক হাজারের উপর মানুষ মারা গেছে। কিছু কিছু মানুষ বাড়ি থেকে বের হতে পারেনি, তাদের বাড়িতে বোমা মার্টারশেলে মারা গেছে। আর কিছু কিছু মানুষের কাছ থেকে টাকা পয়সা কেড়ে নিয়ে সরাসরি গুলি করে মেরে ফেলেছে। পাহাড়ে কিছু কিছু মেয়েদেরকে জুলুম করে মেরে ফেলেছে। আর কিছু কিছু মেয়েদেরকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমাদের কে অনেক কিছু করতে চেয়েছে। মেরে ফেলার জন্য বিলের মধ্যে এনেছে। পরে তাদেরকে আল্লাহর রহমত করছে আমাদেরকে মেরে ফেলেনি। কিছু মানুষ আমরা বেঁচে এসেছি। পরের দিন সকালে আমাদের আত্মীয়-স্বজন ভাই ব্রাদার কে ধরে কোথায় নিয়ে গেছে জানিনা। আমরা এই পৃথিবীর কাছে বিচার চাই আমাদের দেশ চাই। আর কিছু চাইনা।
টেকনাফ শালবাগান রোহিঙ্গা জাকারিয়া বলেন, নতুন করে অনেক রোহিঙ্গা নারী পুরুষ শিশু ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। তারা কোনরকম কষ্ট করে দিন যাপন করছে। মিয়ানমারে অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। শত শত পুরুষ তাদের হাতে জিম্মি রয়েছে। দেশে আছে নাকি মারা গেছে তাও জানিনা। হাজার হাজার নারী শিশু মারা গেছে। এবং নারীরা বেশি নির্যাতন এবং জুলুমের শিকার হয়েছে। যারা দেশে প্রাণ নিয়ে বেঁচে এসেছে। তাঁরাও এখানে অনেক কষ্টের মধ্যে রয়েছে। আমরা সবাই মিলে তাদেরকে সহযোগিতা করে আসছি। আমরা সারা বিশ্বের কাছে রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের কথা তুলে ধরতে চাই। দিন দিন রোহিঙ্গারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আমরা বিচার চাই আমরা আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই। এই নির্যাতন জুলুম আর সহ্য করতে পারছি না। নারীদের নির্যাতনের কথা শুনলে চোখের পানি রাখতে পারি না। ছোট ছোট বাচ্চাদের কষ্ট দেখে বেঁচে থাকার ইচ্ছা ও থাকে না।